ব্রাজিলের শহর সাওপালুতে
আমাদের মেজবান জনাব আলী আহমাদ সাইফী স্বাগত জানানের জন্যে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি মূলত লেবাননী বংশোদ্ভূত। তাঁর পিতা দীর্ঘ দিন ধরে ব্রাজিলে অবস্থান করেন। দুবাইতে বসবাসরত আমার দোস্ত জনাব ইসহাক নূর ও আমানুল্লাহ সাহেবের মধ্যস্থতায় তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি আমার কিতাবসমূহের মাধ্যমে আমার সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
ব্রাজিলে অবস্থনকালে তিনি অত্যন্ত মহব্বতের সাথে আমার মেহমানদারী করেন। সাওপালু ব্রাজিলের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যনগরী।
যার জনসংখ্যা দেড় কোটি বলা হয়। আলী আহমাদ সাইফী সাহেব তাঁর বাড়ির সন্নিকটে হোটেল সদৃশ যে ফ্ল্যাটে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন, তা সাওবারনারডু নামের এক মহল্লায় অবস্থিত। যানজটের কারণে সেখানে পৌঁছতে দেড়ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ঋতু ছিলো অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ঠান্ডা। সেখানেই সে রাত অতিবাহিত করি।
ব্রাজিল দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড়ো দেশ। যা ৩২,৮৬,৪৮৭ বর্গমাইলব্যাপী বিস্তৃত। যে কারণে পুরো মহাদেশের প্রায় অর্ধেক ভূখন্ড এ দেশের। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে এদেশের জনবসতি সর্বাধিক। খ্রিস্ট পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত জগদ্বাসীর নিকট এ ভূখন্ড ছিলো অনাবিষ্কৃত ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের এক নৌ-কমান্ডার (Pedro Alvares Cabral) কলম্বাস ও ভাস্কোডাগামার মতো ভারতের পথ আবিষ্কারের জন্য বের হন। পথ হারিয়ে তিনি দক্ষিণ আমেরিকায় চলে এসে ব্রাজিলের এ অঞ্চল আবিষ্কার করেন।
সে সময় এখানে যে জাতি বাস করতো, তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়নি। তবে বলা হয় যে, তারা ছিলো অসভ্য জাতি। ধীরে ধীরে পর্তুগীজরা যখন জানতে পারলো যে, এখানে অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, তখন তারা এটা দখল করে নেয় এবং একে পর্তুগালের উপনিবেশ বানায়। এ কারণে এদেশে পর্তুগীজ ভাষায় কথা বলা হয়। পর্তুগালের অধিপত্যের পর এ অঞ্চলের আসল অধিবাসীরা দূর-দুরান্তের গ্রামসমূহে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এখানকার অধিবাসীদের বিরাট সংখ্যক ছিলো তাদের, যারা পর্তুগাল থেকে এখানে এসে বসবাস আরম্ভ করে।
এছাড়াও পর্তুগাল সরকার ক্ষেত-খামারের কাজ করার জন্যে আফ্রিকার অনেক কৃষ্ণাঙ্গকে গোলাম বানিয়ে আনে। এভাবে এখানে আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের বিরাট জনবসতি গড়ে ওঠে। অপরদিকে ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক শেতাঙ্গ এসে বসতি স্থাপন করে। এখানকার বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে একটি মিশ্র জাতির উদ্ভব হয়। ষোড়শ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনা পর্যন্ত ব্রাজিল পর্তুগালের অধীনে থাকে। পরবর্তীতে সেখানে স্বাধীনতা আন্দোলন আরম্ভ হয়।
অবশেষে ৭ সেপ্টেম্বর ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে তারা পর্তুগাল থেকে মুক্তি লাভ করে স্বাধীন দেশে পরিণত হয়। স্বাধীনতা লাভের পর এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ব্যবসা ও শিল্পের উপযুক্ত ক্ষেত্র হওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখন্ড থেকে মানুষ মাতৃভূমি ছেড়ে এখানে এসে বসবাস আরম্ভ করে। তার মধ্যে আফ্রিকা ছাড়া ইউরোপ ও আরব দেশের অধিবাসীরাও অন্তর্ভুক্ত। সেই আরব লোকদের মধ্যে অনেক মুসলমানও ছিলেন। তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন দশ লাখে পৌঁছেছে।
তাদের মধ্যে ষাট শতাংশের কাছাকাছি হবে ব্রাজিলীয় নওমুসলিম।
এরপর আরবী বংশোদ্ভূত মুসলমানদের সংখ্যা অধিক। তাদের মধ্যেও লেবাননের অধিবাসীদের সংখ্যা বেশি। এখন কিছু সংখ্যক পাকিস্তানীও রয়েছে।
আলী সাইফীর পিতা আহমাদ সাইফী দীর্ঘদিন পূর্বে লেবানন থেকে ব্রাজিলে স্থানান্তরিত হন। তিনি এখানে মসজিদসমূহ নির্মাণ এবং ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আমার অবস্থানের দ্বিতীয় রাতে আমার সম্মানে তিনি তাঁর বাড়িতে নৈশভোজের আয়োজন করেন। সেখানে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দাওয়াত করেন। সেখানে তাঁরা বলেন যে, আলহামদুলিল্লাহ! ব্রাজিলে একশ'র উপরে মসজিদ রয়েছে।
শুধু সাওপালু প্রদেশেই পঞ্চাশটা মসজিদ রয়েছে। তারা আরো বলেন যে, ব্রাজিলের অধিবাসীদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণ করার আগ্রহ খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পর্তুগীজ ভাষায় ইসলাম প্রচারের যদি ব্যবস্থা করা যেতো তাহলে এর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। (এ সংক্ষিপ্ত অবস্থানকালে কয়েকজন নওমুসলিমের সঙ্গে মিলিত হয়ে আমার কাছেও এ বাস্তবতা তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে।
ইনশাআল্লাহ পরবর্তীতে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করবো।) সে নৈশভোজে যাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে ধার্মিক ও ধর্মীয় আবেগ-উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত পাই। তারা নিজ নিজ অভিজ্ঞতার = কথা আমাকে জানান। আমার আসার সংবাদ শুনে পাকিস্তানী তরুণ ফারহান ডিসাই সাহেব তার কয়েকজন বন্ধুসহ তিন ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে এখানে এসে পৌঁছান।
এরা তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে এ দেশে দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন। তারা বলেন যে, আলহামদুলিল্লাহ! এখানে তাবলীগ জামাতের কাজ তৎপরতার সঙ্গে অব্যাহত রয়েছে।
ব্রাজিলে মুরগীর খামার এতো অধিক যে, তারা সারা বিশ্বে তা রপ্তানী করে । সৌদী আরব ও উপসাগরীয় দেশসমূহে সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে মুরগীর মাংস রপ্তানী হয়। যদিও লেখা থাকে যে, ইসলামী পদ্ধতিতে সেগুলো জবাই করা, কিন্তু তার বাস্তবতা সম্পর্কে সবসময় সন্দেহ-সংশয় থাকে। কারণ ঐ সব দেশে সাধারণত মেশিনের মাধ্যমে মুরগী জবাই করা হয়। আর তাতে শরীয়তের শর্তসমূহ পূরণ হয়না।
এ কারণে আমরা তা খাওয়ার পরামর্শ দেই না। আমার লিখিত 'আহকামুয যাবায়েহ' কিতাবে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আমি পানামা যেতে ব্রাজিলের পথ অবলম্বন করার একটি কারণ এও ছিলো যে, এখানে অবস্থানকালে এ বিষয়ে হয়তো অধিক তথ্য জানার সুযোগ হবে। এবং আলী সাইফী সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগের কারণ এই ছিলো যে, তিনি এবং তার পিতা সে কয়জন ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত, যারা সেখানে মুরগী জবাইয়ের তত্ত্বাবধান করে থাকেন এবং এর সনদপত্র দিয়ে থাকেন।
আমি ব্রাজিল পৌঁছার কয়েকদিন পূর্বে তাদের নিকট আবেদন করি যে, আমার অবস্থানকালে সম্ভব হলে তারা যেন জবাই পরিদর্শনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তারা বলেন যে, ব্রাজিলে জবাই কারখানার আইন এই যে, বহিরাগত কাউকে জৈব নিরাপত্তা পদ্ধতি সম্পন্ন (Quarantine) করার পর কারখানায় প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। এ কারণে সংক্ষিপ্ত এ অবস্থানকালে জবাই পরিদর্শন সম্ভব নয়।
মৌখিকভাবে তারা বলেন যে, কারখানাগুলোতে মুসলমানদের জন্যে মুরগী জবাই করার যে নির্দিষ্ট সময় রয়েছে, তখন মুরগীগুলোকে মেশিনের সাহায্যে জবাই করা হয় না। বরং চারজন কর্মচারী হাতে ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। মুরগী যখন তাদের সামনে দিয়ে যায় তখন তারা 'বিসমিল্লাহ' বলে সেগুলা হাত দিয়ে জবাই করে। এটা সেই পদ্ধতি, 'আহকামুয যাবায়েহ কিতাবে আমি যার প্রস্তাব করেছি।
এর মাধ্যমে এ ভুলবোঝাবুঝি তো দূর হয় যে, সেখানে মেশিনের ছুরি দ্বারা মুরগী জবাই করা হয়, কিংবা 'বিসমিল্লাহ' পড়ার জন্যে কোন টেপ চালু করে দেয়া হয়। কিন্তু আলী সাইফী ও আহমাদ সাইফী দু'টি বিষয় স্বীকার করেন। একটি এই যে, যদিও আমরা জবাইকারীদের উপর এ বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছি যে, তারা প্রত্যেক মুরগীর উপর 'বিসমিল্লাহ' পাঠ করবে এবং তাদের ডিউটির সময় অন্য কোন কাজে মনোনিবেশ করবে না।
কিন্তু তারপরেও তো তারা মানুষ। হাঁচি-কাশি তাদের আসতেই পারে। যে দ্রুত বেগে তাদের সম্মুখ দিয়ে মুরগী পার হয়ে যায়, সে দৃষ্টিতে কিছু মুরগী 'বিসমিল্লাহ' পড়া ছাড়াই পার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। দুই, সব জবাইখানায় জবাই করার জন্যে মুসলমান কর্মী পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। কারণ জবাইয়ের এসব কারখানা শহর থেকে দূরে এমন এলাকায় রয়েছে, মুসলমানগণ যেখানে থাকা পছন্দ করে না।
এ কারণে কতক জায়গায় খ্রিস্টানদেরকেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের উপর আল্লাহর নামে জবাই করার বাধ্যবাধকতাও আরোপ করা হয়েছে। এখন বাস্তবে তারা এর প্রতি কতোটুকু গুরুত্বারোপ করে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।
তাছাড়া তাদের বর্ণনা মতে ব্রাজিলে কমবেশি পঞ্চাশটি জবাইখানা রয়েছে। যার প্রত্যেকটিতে প্রতিদিন হাজার হাজার মুরগী জবাই হয়ে থাকে। সেগুলোতে মুসলমান কর্মীদের তত্ত্বাবধানকারী এবং তাদের সনদ প্রদানকারী ব্যক্তিও ভিন্ন ভিন্ন। তাদের প্রত্যেকের ব্যাপারে একথা বলা সম্ভব নয় যে, তারা সব শর্ত মেনে চলে। এসব মুরগী যখন বাজারে আসে, তখন এটা চিহ্নিত করা খুবই কঠিন যে, এগুলো কোন জবাইখানার এবং কারা এর সনদ দিয়েছে।
সার কথা এই যে, বিস্তারিত এসব তথ্য জানার পরও ব্রাজিল থেকে রপ্তানী করা মুরগীর ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয় দূর হয়নি। হালাল গোশত যোগান দেয়ার জন্যে বিশ্বমানের নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন রয়েছে। আফসোস! মুসলিম দেশসমূহের রাষ্ট্রপ্রধানদের এদিকে মনোযোগ নেই। তবে আমি কতক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদন করেছি যে, তারা যেন নির্ভরযোগ্য আলেমদের তত্ত্বাবধানে এর জন্যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ বিষয়ে প্রাথমিক কিছু পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। আল্লাহ করুন, এগুলো যেন সফলকাম হয়।
সাওপালুতে অবস্থানকালে আমি শহরের কয়েকটি মসজিদও দেখেছি। যেগুলো মাশাআল্লাহ বেশ আড়ম্বরপূর্ণ। সেগুলোর মিনার দূর থেকে দৃষ্টিগোচর হয়। নামাযীদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। আবু বকর মসজিদে' আমরা জুমার নামায আদায় করি। মসজিদটি সেই মহল্লায় অবস্থিত, যেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে একজন মিসরী শায়েখ উচ্চাঙ্গের খুৎবা দেন। ঐ মসজিদের সাথে একটি ইসলামিক সেন্টারও রয়েছে। শিশুদের দ্বীনী তালীমেরও কিছু ব্যবস্থা আছে। একটি মুসলমান রেস্তোরা রয়েছে। মুসলমানদের প্রয়োজন পূরণের একটি দোকানও রয়েছে।
আরেকটি মসজিদেও আমার নামায পড়ার সুযোগ হয়। তার নাম 'মালিক আব্দুল আযীয মসজিদ'। সৌদী সরকারের সাহায্যে তা নির্মিত হয়েছে। মসজিদটি অত্যন্ত সুন্দর ও আড়ম্বরপূর্ণ। তার আয়তনও বেশ বড়ো। বারো বছর ধরে এখানে একটি মাদরাসাও প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তাতে প্রায় একশ' শিশু শিক্ষালাভ করছে।
এতে আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে দ্বীনী শিক্ষারও ব্যবস্থা রয়েছে। তাবলীগ-জামাতের মারকায যদিও এখান থেকে দূরে উমর ইবনুল খাত্তাব মসজিদে' অবস্থিত, তবে 'মালিক আবদুল আযীয মসজিদেই বেশিরভাগ জামাতের আসা-যাওয়া হয়ে থাকে। বর্তমানেও এখানে মরক্কো থেকে একটি জামাত এসেছে।
আলী সাইফীর মামাতো ভাই সুহাইব সাহেবের সঙ্গে আমাদেরকে সাক্ষাত করানো হয়। তাবলীগ-জামাতের কাজ যেসব মানুষের মনে বিপ্লব এনেছে, তার মাধ্যমে তাদের একটি ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে উঠে আসে। এ তরুণ তাবলীগ জামাতের কাজে অত্যাধিক তৎপর। আলী সাহেব বলেন যে, তার বাবা মুস্তাফা আহমাদ উরা লেবাননের সেসব বিত্তশালী লোকদের অন্যতম ছিলেন, যারা ব্রাজিলে এসে দ্বীন-ধর্ম থেকে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েন।
পশ্চিমা সভ্যতার সমস্ত খারাপ দিক তার মধ্যে জায়গা করে নেয়। এমনকি এসব মন্দ অভ্যাসের কারণে তাকে মুসলমান সমাজে ভালো চোখে দেখা হতো না। তার সংশোধনের জন্যে তার বাবা শক্ত নরম সব ধরনের ব্যবস্থাই গ্রহণ করেন। কিন্তু তার জীবনযাপন প্রণালীতে কোনরূপ পরিবর্তনই আসেনি।
অবশেষে ১৯৭১ সালের দিকে ব্রিটেন থেকে একটি তাবলীগ জামাত আসে। জামাতের আমীর সাহেব একস্থানে বয়ান করছিলেন। ঘটনাচক্রে তিনিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বয়ানকারীর আকার-আকৃতি দেখে তিনি মনে মনে ভাবেন যে, ইনি হয়তো কোন মসজিদ বা মাদরাসার জন্যে চাঁদা সংগ্রহ করবেন। এ কারণে তার অন্তরে ঐ ব্যক্তির প্রতি ভালো কোন অনুভূতি জাগেনি।
কিন্তু কী এক অজানা দরদ নিয়ে তিনি বয়ানের মধ্যে বলেন যে- আপনাদের নিকট থেকে আমরা কোন টাকা পয়সা চাই না।
আমরা নিজেদের পয়সা খরচ করে আপনাদেরকে সেই দ্বীনের দাওয়াত দিতে এসেছি, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে এসেছিলেন। তখন তিনি নিজের চিন্তার জন্যে লজ্জিত হন। আল্লাহ তাআলা মুস্ত ফা উরা সাহেবের জীবনের পরিবর্তন চেয়েছিলেন। এরপর তিনি পুরো বয়ান শোনেন এবং তার কথামতো ১৯৭২ সালে পাকিস্তান যান।
সেখান থেকে যখন ফিরে আসেন, তখন তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ। তার পূর্বের জীবন যারা দেখেছে, তারা তাকে এই নতুন রূপে চিনতেই পারেনি। পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে তিনি নিজের পুরো জীবনকে ব্রাজিলে তাবলীগ জামাতের কাজের প্রসার ঘটানোর জন্য ওয়াক্ফ করে দেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এ কাজে ব্যাপৃত থাকেন। সারাদেশে তাবলীগ জামাতের কাজ যে পরিমাণ বিস্তার লাভ করে তাতে তার অবদান মৌলিক গুরুত্ব রাখে। তার ছেলে সুহাইব সাহেব আমাদেরকে তৃতীয় দিন দুপুর বেলা নিজ বাড়িতে বিশ্রামের দাওয়াত দেন।
সেখানে তার পুরো পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত হয়। তাদের সকলকেই তাবলীগের কাজে লেগে থাকতে দেখি।
আলী সাইফী সাহেব আমাদেরকে সাওপালু শহর ঘুরিয়ে দেখান। সাওপালু আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিম তীরে অবস্থিত। উপকূল ধরে সবুজ-শ্যামল পাহাড়ের দীর্ঘসারি অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। পাহাড়গুলোর একদিকে সমুদ্র আর অপরদিকে সেগুলোর কোল ঘেসে প্রাকৃতিক ঝিল, ছোট ছোট জলপ্রপাত ও প্রাকৃতিক বৃক্ষ সমূহের ঘন জঙ্গল ছড়িয়ে আছে। সেগুলোর মধ্যে আম, কলা ও স্থানীয় কিছু ফলের গাছও রয়েছে। আমগাছ এখানে প্রাকৃতিকভাবে জন্মায় ।
আমেভরা গাছ জায়গায় জায়গায় এমনকি সড়কের উপরেও চোখে পড়ে। সবশ্রেণীর মানুষ বিনামূল্যে তা ভোগ করে। এ পুরো অঞ্চলটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। যার নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী উপভোগ করতে করতে আমরা সাওপালুর বন্দর নগরী সান্তোস (Santos) অতিক্রম করি।
এটি দক্ষিণ আমেরিকার সর্ব বৃহৎ বন্দর নগরী। এখানে ছোট একটি শহর রয়েছে। তার মধ্যে একটি মসজিদও রয়েছে। পথে কাবাতা (Cubateo) নামক আরেকটি ছোট শহর পড়ে। সেখানে গ্যাসের কূপ ও তেল শোধনাগার রয়েছে। যে কারণে এখানকার বাতাসে তেল ও গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে আছে। বলা হয় যে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণ (Pollution) এখানেই হয়ে থাকে।
তারপর আলী সাইফী সাহেব আমাদেরকে একটি সুন্দর উপকূলীয় শহরে নিয়ে যান। যার নাম গুয়ারূজা (Guaruja)। তার মেয়র একজন মুসলমান। শহরটি আটলান্টিক মহাসাগরের এক আকর্ষণীয় তীরে অবস্থিত। যেখানে সমুদ্রকে সবুজ পাহাড়ের সঙ্গে খেলা করতে দেখা যায়। বসন্ত ঋতু এখানে আসি আসি করছিলো। সর্বত্র সুবুজ ঝাড় উদগত হচ্ছিলো । প্রশান্তি ময় এসব প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে কিছু সময়ের জন্যে সফরের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
সাওপালু (স্থানীয় লোকেরা 'সোপালু' উচ্চারণ করে) ব্রাজিলের সবচেয়ে বড়ো বাণিজ্যিক শহর । পুরো দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ শিল্পকেন্দ্রও এটি। এর জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। কথিত আছে যে, ২৫শে জানুয়ারী ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান মিশনারীরা এর ভিত্তি স্থাপন করে। এ তারিখটি যেহেতু বর্তমানের বিকৃত খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সেন্টপল এর জন্মতারিখ, তাই এ শহরের নাম রাখা হয় 'সেন্টপল'।
কিন্তু পর্তুগীজ উচ্চারণরীতি অনুসারে একে 'সাওপালু' বা 'সোপালু' বলা হয়। শহরের প্রধান সড়ক পোলিস্তা এ্যাভিনিউ (Paulista Avenue) তার আড়ম্বপূর্ণ আকাশচুম্বী ভবনের কারণে নিউইয়র্কের পার্ক এ্যাভিনিউয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ অঞ্চলেই লস-এঞ্জেলসের বাজারের মতো অত্যাধিক অগ্নিমূল্যের একটি প্রসিদ্ধ বাজারও রয়েছে।
সাওপালুতে দুদিন অবস্থান করার পর আমাদের যাত্রার সময় ঘনিয়ে এলে আলী সাইফী সাহেব বলেন- আপনি যদি ব্রাজিলীয় ধাঁচের মাছ এবং এখানকার কতক হালাল খাবার না খেয়ে চলে যান তাহলে যেন আপনার ব্রাজিলই দেখা হলো না। সুতরাং তিনি সাওপালুর একটি সুদৃশ্য রেস্তোরায় আমাদেরকে দুপুরের খাবার খাওয়ান।
যেখানে বাস্তবিকই অত্যন্ত সুস্বাদু সবজি, আচার ও বিভিন্ন ধরনের মাছের এমন সমন্বয় ছিলো, যা ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি। খানায় তিনি মুস্তাফা উররা সাহেবের ছেলে সুহাইব সাহেবকেও দাওয়াত করেছিলেন- যার আলোচনা আমি পূর্বে করেছি। খানা খাওয়ার পর তার বাড়িতে বিশ্রাম করার জন্যে তিনি দাওয়াত দেন। তারপর আমরা সেখান থেকে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই ।
রিও ডি জানেরিও শহরে
এরপর আমারা ব্রাজিলের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর রিও ডি জানেরিওতে (যাকে সংক্ষেপে 'রিও' বলা হয়) দু'দিন অবস্থান করবো এবং সেখান থেকে পানামার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। আলী সাইফী সাহেবের সাথে ব্রাজিলীয় একজন নওমুসলিম যুবক কাজ করেন। তার ইসলামী নাম আবু বকর।
আলী সাহেব আমাদের পূর্বেই তাকে রিউ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে তিনি সেখানে আমাদেরকে স্বাগত জানাতে এবং সেখানে অবস্থানকালে আমাদেরকে দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।
তিনি রিউ-এরই অধিবাসী। চাকুরীর সুবাদে সাওপালু অবস্থান করেন। তার মাতৃভাষা যদিও পর্তুগীজ, কিন্তু অত্যন্ত সাবলীলভাবে ইংরেজী বলেন। অন্যথায়য় রিউতে ইংরেজী জানা লোক খুবই কম। আমরা মাগরিবের নামায বিমানবন্দরে পড়ে টিম এয়ারলাইনসের একটি ব্রাজিলীয় বিমানে রিউ পৌঁছি।
আবু বকর সাহেব স্বাগত জানানোর জন্যে গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। গাড়িতে আরোহণ করে হোটেলে যাওয়ার পথে আমি তাকে তার ইসলাম গ্রহণের কথা জিজ্ঞাসা করি। তিনি তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা সবিস্তারে বলেন।
তিনি বলেন যে, আমার ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে কিছু তথ্য জানার আগ্রহ জন্মে। আগে থেকে আমার ইংরেজী জানা ছিলো। যেসব চ্যানেল টেলিভিশনে ইসলামী তথ্য উপস্থাপন করে সেগুলো দেখতে থাকি এবং এমন কিছু ভিডিও ক্যাসেট সংগ্রহ করি, যেগুলো ইংরেজীতে ইসলাম ও মুসলমানদের পরিচিতি তুলে ধরে।
যার ফলে ইসলামের প্রতি আমার আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমার মধ্যে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনচরিত পাঠ করার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
এ সময় রিউ-এর একটি পুরাতন মসজিদে সুদানের একজন আলেমের সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়। তিনি আমার আগ্রহ দেখে নিজ থেকেই সীরাতের উপর পাঠদান করার ওয়াদা করেন।
ঘটনাচক্রে সে সময় ইন্টারনেটের মাধ্যমে সাওপালুর এক ব্রাজিলিয়ান তরুণীর সঙ্গে আমার আলাপ (Chat) হতো। সে ছিলো কট্টর প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান। নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস হওয়ার ঘটনায় তার অন্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে মারাত্মক বিদ্বেষ জন্মায় এবং সে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এ উদ্দেশ্যে সে ইসলাম সম্বন্ধে অধ্যয়ন করতে আরম্ভ করে। কুরআনে কারীমের অনুবাদ এবং হুযুর সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনচরিত অধ্যয়ন করে। এ অধ্যয়নের ফলে তার অন্তরে বিপ্লব ঘটে যায়। তার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মায় যে, ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম।
এদিকে আমি সুদানী আলেমের নিকট রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনচরিত পাঠ করছিলাম। ওদিকে ঐ তরুণী ব্যক্তিগতভাবে তাঁর জীবনচরিত অধ্যয়ন করছিলো। আমরা একে অপরকে কখনো দেখিনি।
শুধু ইন্টারনেটে যোগাযোগ হতো। ঘটনাচক্রে আমাকে এক কাজে সাওপালু যেতে হয়। তখন আমি তার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ করে নেই এবং আমরা পরস্পরকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেই। তারপর ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে আমি আমার সুদানী উস্তাযের মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করি। ঐ তরুণীর সঙ্গে আমার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা আলোচনা করলে সে তার কাহিনী শোনায় এবং বলে যে, আমি পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছি।
এভাবে আমাদের বিবাহ এমন অবস্থায় হয় যে, আমরা উভয়ে পূর্ব থেকেই মুসলমান ছিলাম।
আমাদের মেযবান আমাদের জন্যে একটি ট্যাক্সির ব্যবস্থা করেছিলেন। ট্যাক্সিচালক সাঈদও ছিলেন ব্রাজিলিয়ান নওমুসলিম। পর্তুগীজ ছাড়া অন্য কোন ভাষা তিনি জানতেন না।
আমি আবু বকর সাহেবের মাধ্যমে তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা জানতে চাই। তখন তিনি বলেন যে, আমার এক তরুণ ছেলে ছিলো। সে একজন মুসলমান উস্তাযের কাছে যাতায়াত করতো। তাঁর মাধ্যমে তার অন্তরে ইসলাম সম্বন্ধে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
সে কিছুদিন পর ইসলাম কবুল করে এবং আমাকেও ইসলামের দাওয়াত দেয়। আমিও ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো জেনে মুসলমান হয়ে যাই। আমার ছেলে বর্তমানে দ্বীনী শিক্ষা লাভ করার জন্যে সুদান অবস্থান করছে।
এ দু'টি ঘটনা তো আমি ঐ নওমুসলিমদের থেকে সরাসরি শুনি। আবু বকর সাহেব বলেন- এখানে প্রতি সপ্তাহে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক মুসলমান হওয়ার জন্যে ইসলামিক সেন্টারে এসে থাকে। ব্রাজিলে যদিও ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু মানুষ এ ধর্ম থেকে বিমুখ হয়ে চলেছে। যে-ই ইসলামের স্বরূপ জানতে পারে সে-ই ইসলাম গ্রহণ করে।
আবু বকর সাহেব আরো বলেন যে, এখানকার লোকেরা অসাম্প্রদায়িক এবং যুক্ত মনের অধিকারী। অন্যান্য পশ্চিমা দেশের তুলনায় এরা মুসলমানদের প্রতি অধিক সংবেদনশীল। এমনকি এখানের দশজন মানুষের সামনে ইসলামকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হলে আমার অনুমান এই যে, তার মধ্যে তিনজনই ইসলাম গ্রহণ করবে। কিন্তু সমস্যা হলো এখানকার লোক পর্তুগীজ ছাড়া অন্য কোন ভাষা বোঝে না। পর্তুগীজ ভাষায় তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার যোগা = লোকের এখানে খুব অভাব।
সুতরাং পর্তুগাল থেকে আমাদের এখানে তাবলীগ জামাতের লোক আসলে খুব ফায়দা হয়। কিন্তু অন্যান্য এলাকার জামাত যেহেতু এখানকার ভাষা জানে না, তাই তাদের দ্বারা উপকার হয় খুব সীমিত আমি নিবেদন করি যে, এসব জামাত মূলত এখানকার আরব মুসলমানদের মধ্যে এজন্যে কাজ করে থাকে, যেন তারা দাওয়াত দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয় এবং পর্তুগীজ ভাষায় তারা কাজ করতে সক্ষম হয়।
আমি আরো নিবেদন করি যে, বাহির থেকে পর্তুগীজ ভাষা সম্পর্কে অবগত অধিক সংখ্যক আলেম ও দায়ীর এখানে আসা তো বেশি মুশকিল মনে হচ্ছে, তবে এমন কিছু তরুণ যদি তৈরী হয়ে যায়, যারা আমাদের এখানে এসে দ্বীন শিক্ষা করবে। তারপর নিজেদের দেশে এসে কাজ করবে, তাহলে ইনশাআল্লাহ অনেক বেশি ফায়দা হবে।
আবু বকর সাহেবের নিকট এসব ঘটনা ও বিবরণ শুনে অন্তরে অপরাধ বোধ জাগে যে, আমরা অমুসলিমদের সামনে ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরার এমন কোন উপযুক্ত পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারিনি, যার মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখন্ডের অধিবাসীদেরকে ইসলামের আলো দেখানোর কার্যকর ব্যবস্থা করা যায়।
জামাত, দল, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন তো অনেক আছে, কিন্তু বিশেষভাবে এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিষ্ঠান নেই।
যদিও আমি বলে দিলাম যে, ব্রাজিলের কিছু তরুণ আমাদের দেশে আসলে অনেক বেশি ফায়দা হতো। কিন্তু আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে বহিরাগত মাদরাসা ছাত্রদের উপর এতো বেশি বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে যে, তাদের ভিসা পাওয়া বাঘের দুধ সংগ্রহের চেয়ে কম জটিল নয়।
আমরা প্রতিনিয়ত এ সমস্ত সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছি। কারণ, মুসলমান সরকারদের প্রাধান্যের তালিকায় ইসলামের দাওয়াত সর্বনিম্ন পর্যায়ের কোন গুরুত্বও রাখে না। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! এটা তো আল্লাহ তাআলার বিশেষ দয়া এবং ইসলামের অলৌকিকতা যে, উপায়-উপকরণের অভাব সত্ত্বেও মানুষকে নিজের দিকে আকর্ষণ করছে। অন্যথায় বাস্তবতা হলো, আমাদের পক্ষ থেকে এ জন্যে কার্যকর কোন চেষ্টা নেই।
রিও ডি জানেরিওতে মুসলমানের সংখ্যা সাওপালুর তুলনায় অনেক কম। পুরো এলাকায় মোট পঞ্চাশটি মুসলিম পরিবার বসবাস করে। এ কারণে এখানে নিয়মতান্ত্রিক কোন মসজিদ ছিলো না। তবে জামাতে নামায পড়ার জন্যে দু একটি অস্থায়ী নামায ঘর ছিলো। এখন কুয়েতের অর্থায়নে একটি সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। তার সঙ্গে ইসলামিক সেন্টার এবং শিশুদের দ্বীন শিক্ষার একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও রয়েছে।
এ উদ্দেশ্যে আলজামইয়াতুল = খাইরিয়্যাতুল ইসলামিয়্যা নামে একটি সংগঠন রয়েছে।
তার সভাপতি লেবাননের অধিবাসী জনাব যায়নুল আবেদীন আমাদেরকে ঐ মসজিদে আসার দাওয়াত দেন। মসজিদের নির্মাণ কাজ অনেকটাই সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু ইসলামিক সেন্টার ও মাদরাসা হিসেবে ব্যবহারের জন্যে তৎসংলগ্ন ভবনসমূহ এখনো নির্মাণাধীন রয়েছে।
বরং অর্থাভাবে নির্মাণ কাজ থেমে আছে। সংগঠনের সভাপতি ও সেক্রেটারী জনাব সামি সাহেব বলেন যে, এখনো কুরআন-হাদীস প্রভৃতির দরস এখানে অব্যাহত রয়েছে। শিশুদের জন্যে সাপ্তাহিক তারবিয়াতী প্রোগ্রামও হয়ে থাকে। কিন্তু সবকিছু দেখে অনুমান হয় যে, এ কাজগুলো এখানে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
এখনো অনেক কিছু করা বাকী রয়েছে। যারা এ কাজে কোন প্রকার সহযোগিতা করতে চান তাদের জন্যে নিম্নে টেলিফোন নম্বর দেয়া হলো ।
ফোন নং- ০০৫৫212241079 ও 00552 ১৯৩৭ ৪৮৬৪৬।
ঐ মসজিদেই আমি যোহরের নামায পড়াই। দেখলাম, অতি কষ্টে এক কাতার লোক হয়েছে।
রিও ডি জানেরিও অত্যন্ত উন্নত শহরগুলোর মধ্যে পরিগণিত হয়। আবু বকর সাহেব বললেন, পর্তুগীজ ভাষায় 'রিউ' শব্দের অর্থ নদী, আর 'জানেরিও' বলে জানুয়ারী মাসকে। এ অঞ্চলে এসে সমুদ্র একটি নদীর রূপ ধারণ করছে। পর্তুগীজরা এটি জানুয়ারী মাসে আবিষ্কার করে।
এ কারণে এর নাম 'রিও ডি জানেরিও' রাখা হয়। প্রায় দুই শতাব্দীকাল এটি ব্রাজিলের রাজধানী ছিলো। পরবর্তীতে রাজধানীর জন্যে নতুন শহর ব্রাজিলিয়া নির্মাণ করা হলে রাজধানী সেখানে স্থানান্তরিত হয়। সাওপালুর তুলনায় রিউ-তে অনেক বেশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিদ্যমান। একটি সুন্দর উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত ওয়ান্ডসার হোটেলে আমরা অবস্থান করি। যার বাইশতম তলার কক্ষ থেকে মোড় নেয়া উপকূলীয় সড়ক, তার উঁচু উঁচু ভবন এবং তীরে আছড়ে পড়া আটলান্টিক মহাসাগরের ঢেউসমূহ সবসময় দৃষ্টিগোচর হয়। রিউ-তে আরো কয়েকটি উপকূলীয় অঞ্চল রয়েছে।
যেগুলোর প্রত্যেকটিই ব্যতিক্রমী সৌন্দর্যের অধিকারী। আবু বকর সাহেব আমাদেরকে পেহ্লাদা গাভা (Pedrada Gava) নামক উপকূলীয় অঞ্চলে নিয়ে যান। এখানে পাহাড়ের চূড়া গম্বুজের আকার ধারণ করেছে। কোথাও মনে হয়, যেন পাহাড়কে মুকুট পরিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সমস্ত পাহাড়ের চূড়া থেকে সমুদ্রকে অর্ধ চন্দ্রাকৃতির মনে হয়। তার পাদদেশের সবুজ-শ্যামলিমায় পরিপূর্ণ পাহাড় ও উপত্যকাসমূহ নৈসর্গিক শিল্পকর্মের বিস্ময়কর দৃশ্য তুলে ধরে।
فتبارك الله أحسن الخالقين
'সুন্দরতম স্রষ্টা আল্লাহ, বরকতময়।
আবু বকর সাহেব গাড়িতে করেই শহরের মধ্যে একটি চক্কর দেন এবং তার বিশেষ বিশেষ ভবনসমূহ ঘুরে দেখান। তার মধ্যে একটি ভবন সম্পর্কে- যা দূর থেকে অদ্ভুত আকৃতির দেখা যাচ্ছিলো- বলেন যে, এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ফুটবল স্টেডিয়াম। এখানের ভবনসমূহের গঠনও কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকের এবং তার সার্বিক ধরন একটি উন্নয়নশীল কিন্তু বিরল ধরনের শহরের দৃশ্য উপস্থাপন করে।
ব্রাজিল ছিলো আমার পানামা যাওয়ার পথের একটি মনযিল। যেখানে কিছুটা অবসর মনে চারদিন অতিবাহিত করার সুযোগ লাভ হয়। এ চারদিন এখানকার অবস্থা জানা এবং বিশ্বের ষষ্ঠ মহাদেশের সর্ববৃহৎ দেশ ভ্রমণে অতিবাহিত হয়। যেখানে ইতিপূর্বে কখনো আসা হয়নি।
তথ্যসূত্রঃ বইঃ "পৃথিবীর দেশে দেশে"
[ মাকতাবাতুল আশরাফ]